নাম তাঁর অ্যান্টনি ফ্লু, পুরো নাম অ্যান্টনি জোরাড নিউটন ফ্লু। জন্ম ১৯২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে। মেথডিস্ট(জন এবং চার্লস ওয়েসলি কতৃর্ক প্রবর্তিত খ্রীষ্টিয় মতবাদ) ধর্মযাজকের পুত্র হওয়াতে এবং ক্রিশ্চিয়ান বোর্ডিং স্কুলে পড়াশুনা করার ফলে ক্রিশ্চিয়ান ধর্মের গভীরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিশোর বয়সেই দেখলেন, প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্মের স্রষ্টার সাথে অশুভ শক্তির মতবাদ (যে মতবাদে বিশ্বাস করা হয় স্রষ্টা সর্বশক্তিমান, এবং অশুভ শক্তিকে পর্যাপ্ত শক্তিও দিয়েছেন) পরস্পর বিরোধী। তখনই মূলত তিনি নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে যান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘রয়াল বিমান বাহিনী’তে যোগদান করেন এবং যুদ্ধ শেষে অক্সফোর্ডের সেন্ট জোন্স কলেজে দর্শন অধ্যায়ন শুরু করেন। সেখানে থাকাকালীন আঠারো শতকের স্কটিশ প্রখ্যাত দার্শনিক ডেভিড হিউমের ‘স্রষ্টা এবং বিবিধ ধর্মীয় রীতিনীতির’ সমালোচনামূলক লেখনী পড়ে প্রভাবিত হন।
১৯৫০ সালে ফ্লু ‘ধর্মতত্ত্ব এবং বিকৃতিকরণ’ নামে একটি লেখনী অক্সফোর্ড সক্রেটিক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট এবং এ্যাপোলোজিস্ট সিএস লুইসের(ক্লাইভ স্টাপেলস লুইস) নিকট প্রদান করেন। এ্যাপোলোজিস্ট বলতে মূলত তাঁদেরকে বোঝায় যারা ধর্ম সম্পর্কিত বিভিন্ন বিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেন। ফ্লু তাঁর লেখনীতে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, প্রচলিত ধর্মীয় মতবাদ স্রষ্টার অস্তিত্ব, ক্ষমতা সম্পর্কে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ।
খুব দ্রুতই ফ্লু ধর্মদর্শন বিষয়ক বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন এবং নিরীশ্বরবাদের জনপ্রিয় বক্তা হয়ে যান। নিরীশ্বরবাদের উপর লেখা ফ্লুয়ের লেখনী, বক্তব্য গুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘ধর্ম ও দর্শন’(রিলিজিয়ন এন্ড ফিলোসফি) এবং ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘নিরীশ্বরবাদী মানবধর্ম’(অ্যাথেস্টিক হিউমানিজম) বই দুটি নিরীশ্বরবাদের উপর এমন জোড়ালো যুক্তি দেয় যে, পরবর্তীতে বই দুটিকে পাঠ্যপুস্তকের আওতায় আনা হয়। ফ্লুয়ের লেখার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় পরবর্তী সময়েরই ‘নিরীশ্বরবাদ’ তত্ত্বে বিশ্বাসী পাঠ্যপুস্তক লেখক স্যাম হ্যারিস এবং রিচার্ড ডওকিন্সের লেখানিতে।
উল্লেখ্য, এই পুরো সময়েও ধর্ম সম্পর্কে ফ্লুয়ের গবেষণা থেমে থাকেনি, নিয়মিত পড়াশুনা করেছেন এবং দার্শনিক, এ্যাপোলোজিস্টদের সাথে আলোচনা চালিয়ে গেছেন। বিশেষ করে আমেরিকান খ্রিষ্টানধর্ম প্রচারক গ্যারি হাবেরম্যাস এবং ইহুদি ধর্মপ্রচারক জেরাল্ড স্রোডারের সাথে নিয়মিত আলোচনায় বসতেন।
২০০৪ সালে হঠাৎ করেই শোনা গেলো, ফ্লু তাঁর নিজস্ব মতবাদ থেকে সরে এসেছে। তিনি আর নিরীশ্বরবাদে বিশ্বাসী নন, বরং বলা যায় কিছুটা ‘শ্বরবাদ’র দিকে ঝুঁকেছেন। ‘শ্বরবাদ’ হল এমনই এক মতবাদ যেখানে বিশ্বাস করা হয়, এ মহাজগতের একজন স্রষ্টা অবশ্যই আছেন কিন্তু প্রচলিত ধর্মনীতি তাঁর কতৃর্ক প্রদত্ত নয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে স্রস্টার উপস্থিতি সম্পর্কে যুক্তি দেখান। তাঁর এ বিবৃতি ধর্মপ্রচারকের কাছে সমাদৃত হলেও ফ্লু নিরীশ্বরবাদীদের রোষানলে পড়েন। তাঁদের ধারণা, শেষ বয়সে এসে ফ্লু ‘এ্যপেশিয়া’তে আক্রান্ত হয়েছে(ডিসপেশিয়া নামেও পরিচিত, এ মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিস্কে আঘাতজনিত কারণে কথাবার্তা এবং চলাফেরার মধ্যে অসংলগ্নতার সৃষ্টি হয়)। অনেকে আবার তাঁর স্রষ্টা সম্পর্কে এ মতবাদকে অ্যারিস্টেটোলের অবিচল ঘুরন্ত বস্তুর সাথে তুলনা করেছেন। উল্লেখ্য, আস্তিক হলেও ফ্লু কখনও প্রচলিত ধর্মের অনুসরণ করেননি, এবং তিনি ছিলেন মৃত্যুর পরের জীবনের ঘোর অবিশ্বাসী। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের কাছে একটি প্রস্তাব করা হয় যেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে ‘ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রস্তাবে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে সেদিন প্রস্তাবে অ্যান্টনি ফ্লুও স্বাক্ষর করেন। ‘ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন’ হল এমন একটি মতামত যেখানে বলা হয় অসম বুদ্ধির অধিকারী একজন ডিজাইনার সকল প্রাণীর আকৃতি, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির উন্নত ভার্সনের নকশা করেছেন। ২০০৭ সালে প্রকাশ হয় ফ্লু এবং খ্রিষ্টান লেখক রয় আব্রাহাম ভার্গিসের সম্মিলিতভাবে লেখা বই ‘ঈশ্বর উপস্থিতঃ কিভাবে পৃথিবীর কুখ্যাত নাস্তিকের ধারণা বদল হল’( দেয়ার ইজ এ গডঃ হাউ দ্যা ওয়ার্ল্ডস’ মোস্ট নটোরিয়াস এ্যথিস্ট চেইঞ্জড হিস মাইন্ড)। এ বই প্রকাশিত হওয়ার পর নিরীশ্বরবাদীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন ফ্লু। তারা আরও ক্ষিপ্ত হন যখন জানা যায়, বইয়ের অধিকাংশ অংশই লিখেছেন রয় আব্রাহাম ভার্গিস এবং একজন নেপথ্য লেখক।
২০১০ সালের আট এপ্রিল ইংল্যান্ডের রিডিংয়ে এ দার্শনিক আটাশি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ধর্মের পাশাপাশি এ বুদ্ধিজীবী দর্শন, রাজনীতি, শিক্ষা, সমাজবিজ্ঞানের উপরেও অনেক বই লিখেন। তার মধ্যে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘হিউমের বিশ্বাসের দর্শন’(হিউমস’ ফিলসফি অব বিলিফ) এবং ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘সমাজবিজ্ঞান, সমতা এবং শিক্ষা’(সোসিয়োলজি, ইকুয়ালিটি এন্ড এডুকেশন) ইত্যাদি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
0 Comments